ব্লকচেইন কি । ব্লকচেইন কিভাবে কাজ করে
ব্লকচেইন প্রযুক্তি বিগত এক দশকে বিপ্লব ঘটিয়েছে প্রযুক্তির দুনিয়ায়। এটি একটি বিশেষ ধরনের ডিস্ট্রিবিউটেড ডেটাবেস বা লেজার সিস্টেম, যা নিরাপদ এবং স্বচ্ছ লেনদেন নিশ্চিত করতে ব্যবহৃত হয়। ব্লকচেইন ব্যবস্থার মূল ধারণা হলো একাধিক নোড বা কম্পিউটার একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে কাজ করে এবং নির্দিষ্ট একটি কনসেন্সাস প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ব্লক তৈরি এবং যাচাই করে। ব্লকচেইনের সিকিউরিটি, ট্রান্সপারেন্সি এবং নির্ভরযোগ্যতা এটিকে শুধু ক্রিপ্টোকারেন্সির জন্য নয়, বরং বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহারের জন্য একটি আদর্শ প্রযুক্তি তৈরি করেছে।
ব্লকচেইন কিভাবে কাজ করে
ব্লকচেইনের কার্যপদ্ধতি বোঝার জন্য আমাদের প্রথমে এর গঠন এবং উপাদানগুলো সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। ব্লকচেইন মূলত একটি সিস্টেম যেখানে তথ্য ‘ব্লক’ আকারে সংরক্ষিত হয় এবং প্রতিটি ব্লক পূর্ববর্তী ব্লকের সাথে চেইন হয়ে থাকে। ব্লকচেইন প্রযুক্তির কাজ করার পদ্ধতি মূলত নিম্নলিখিত পর্যায়গুলির মধ্যে দিয়ে ঘটে:
ব্লক: ব্লক হল ব্লকচেইনের মৌলিক ইউনিট। এটি তথ্য ধারণ করে, যেমন লেনদেনের বিস্তারিত, তারিখ এবং সময়। ব্লকের মধ্যে থাকে একটি হ্যাশ কোড (বিশেষ ডিজিটাল স্বাক্ষর), যা ব্লকের বিশেষ পরিচয় হিসেবে কাজ করে। ব্লকের প্রতিটি তথ্য সংরক্ষণ হওয়ার পর, একটি হ্যাশ তৈরি করা হয় এবং সেই হ্যাশটি পরবর্তী ব্লকের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এটি নিশ্চিত করে যে একটি ব্লক পরিবর্তন হলে পরবর্তী ব্লকের হ্যাশও পরিবর্তিত হবে, যা সিস্টেমকে অবৈধ কার্যকলাপ থেকে রক্ষা করে।
হ্যাশিং: ব্লকচেইনের হ্যাশিং পদ্ধতি তথ্য সুরক্ষিত রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়। হ্যাশিং হল একটি অ্যালগরিদম, যা কোনো ইনপুট ডেটাকে একটি নির্দিষ্ট আউটপুটে রূপান্তরিত করে। এটি একটি একমুখী ফাংশন, অর্থাৎ ডেটা একবার হ্যাশ হয়ে গেলে তা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। ব্লকচেইনে হ্যাশিং একে অপরের সাথে সংযুক্ত ব্লকগুলোর স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করে।
ডিস্ট্রিবিউটেড নেটওয়ার্ক: ব্লকচেইন সিস্টেমটি একাধিক কম্পিউটার বা ‘নোড’-এর মধ্যে বিভক্ত থাকে। এর অর্থ হলো, একক কোনো কর্তৃপক্ষের পরিবর্তে সমস্ত নোড একে অপরকে সঙ্গী হিসেবে কাজ করে। তথ্যের পরিবর্তন বা ব্লক তৈরির আগে, পুরো নেটওয়ার্কের মধ্যে সম্মতি প্রয়োজন হয়। এর ফলে কোনো একক ব্যক্তি বা দল পুরো সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, এবং এটি সিস্টেমের দুর্বলতাগুলিকে নির্মূল করে।
কনসেন্সাস অ্যালগরিদম: ব্লকচেইনের কার্যক্রম নিশ্চিত করতে একটি কনসেন্সাস অ্যালগরিদমের প্রয়োজন হয়। কনসেন্সাস অ্যালগরিদম হলো সেই প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে নেটওয়ার্কের সমস্ত নোড একমত হয় যে, কোন ব্লক বা তথ্য সঠিক এবং বৈধ। সবচেয়ে সাধারণ কনসেন্সাস অ্যালগরিদম হল প্রুফ অব ওয়ার্ক (PoW), যা বিটকয়েনসহ অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সির সিস্টেমে ব্যবহৃত হয়। এতে, নোডগুলো একটি গণনাগত সমস্যা সমাধান করে, এবং এটি সঠিকভাবে সমাধান হলে নতুন ব্লকটি ব্লকচেইনে যুক্ত হয়।
প্রুফ অব স্টেক (PoS): প্রুফ অব স্টেক হল প্রুফ অব ওয়ার্কের একটি বিকল্প। এটি সিস্টেমের কম্পিউটেশনাল শক্তির পরিবর্তে, ব্লকচেইন নোডের স্টেক (অর্থাৎ, একটি প্রিভিউস ব্লকটির সত্ত্বাধিকারী হিসাবে কারো ‘স্টেক’ করা অর্থ) ব্যবহার করে ব্লক তৈরি করার অনুমোদন দেয়। এটি কম শক্তির ব্যবহার এবং আরও দ্রুত লেনদেন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে।
ব্লকচেইনের সুবিধাসমূহ
ব্লকচেইন প্রযুক্তি বিভিন্ন দিক থেকে প্রচলিত সিস্টেমগুলোর চেয়ে অনেক বেশি কার্যকরী। এর প্রধান সুবিধাসমূহ হল
স্বচ্ছতা ও অখণ্ডতা: ব্লকচেইন একটি পাবলিক এবং স্বচ্ছ লেজার সিস্টেম হিসেবে কাজ করে, যার ফলে সব লেনদেন বা কার্যকলাপ সহজে যাচাই করা যায়। একবার তথ্য ব্লকচেইনে এন্ট্রি হওয়ার পর, সেটি পরিবর্তন করা বা মুছে ফেলা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এটির ফলে ডিজিটাল তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয় এবং ডেটার অখণ্ডতা বজায় থাকে।
নিরাপত্তা: ব্লকচেইনে ডেটার প্রতি ব্লক একটি হ্যাশ কোড দ্বারা সংযুক্ত থাকে, যা পরিবর্তিত হওয়ার সাথে সাথে সিস্টেমকে সতর্ক করে দেয়। ব্লকচেইনের নোডগুলো সম্মতিতে ব্লকগুলো যাচাই করে এবং যেকোনো অনুপ্রবেশ বা ত্রুটি সনাক্ত করতে সক্ষম হয়।
ডিসেন্ট্রালাইজেশন: ব্লকচেইন প্রযুক্তির একটি বড় সুবিধা হলো এটি ডিসেন্ট্রালাইজড, অর্থাৎ কোনো কেন্দ্রীয় অথরিটি বা প্রতিষ্ঠান নেই যা পুরো সিস্টেমটি নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে সিস্টেমে স্বতন্ত্রতা থাকে এবং কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের দ্বারাও তথ্য পাল্টানোর সুযোগ থাকে না।
কম খরচে লেনদেন: ব্লকচেইনে লেনদেন কম খরচে এবং দ্রুত সম্পন্ন হয়, কারণ এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা অন্যান্য মধ্যস্বত্বভোগীর প্রয়োজন নেই। এর ফলে ব্যবসায়িক লেনদেন আরও দ্রুত এবং সাশ্রয়ী হয়ে ওঠে।
স্বয়ংক্রিয় স্মার্ট কন্ট্রাক্ট: ব্লকচেইন স্মার্ট কন্ট্রাক্ট তৈরি করতে সক্ষম, যা কোনো প্রকার তৃতীয় পক্ষ ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে লেনদেনের শর্ত পূরণ করে। স্মার্ট কন্ট্রাক্টগুলি নির্ধারিত শর্ত পূরণ হলেই কার্যকর হয়, যা ব্যবসায়িক চুক্তির প্রক্রিয়া আরও কার্যকরী করে।
ব্লকচেইন প্রযুক্তির ব্যবহার
ব্লকচেইন প্রযুক্তি বর্তমানে শুধুমাত্র ক্রিপ্টোকারেন্সি নয়, বরং বিভিন্ন শিল্পের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হল
ক্রিপ্টোকারেন্সি: বিটকয়েন এবং এথেরিয়াম প্রধান ব্লকচেইন ভিত্তিক ক্রিপ্টোকারেন্সি। এই সিস্টেমে, লেনদেনের তথ্য ব্লকচেইনে সংরক্ষিত হয়, যা সিস্টেমের নিরাপত্তা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে।
বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত ব্লকচেইন: ব্লকচেইন প্রযুক্তি সাপ্লাই চেইন, স্বাস্থ্যসেবা, ভোটদান ব্যবস্থা, বুদ্ধিমান চুক্তি, আইনি চুক্তি এবং ব্যাংকিং সিস্টেমের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে আরও নির্ভরযোগ্য এবং স্বচ্ছ বানায়।
ব্লকচেইন প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন খাতে পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা রাখে। যদিও এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, যেমন স্কেলেবিলিটি এবং শক্তির ব্যবহারের সমস্যা, তবুও এটি আগামীর প্রযুক্তির একটি বড় অংশ হতে চলেছে। ভবিষ্যতে ব্লকচেইন আরো আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে আমাদের জীবনকে আরও সহজ, দ্রুত, এবং নিরাপদ করে তুলবে।